কর্মকর্তাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দলকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ব্যাংকে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অভিযোগ উঠেছে। এর মাধ্যমে ঊর্ধ্বতন একটি মহল নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টা করছেন বলে জানা গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তাদের একটি অরাজনৈতিক সংগঠনের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সাম্প্রতিক উত্তেজনার প্রেক্ষিতে অনুসন্ধানে এমন তথ্য মিলেছে।
রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকের দুই ডেপুটি গভর্নরের পদত্যাগের দাবিতে দিনভর মতিঝিলস্ত প্রধান কার্যালয়ে আন্দোলন করেছেন ২০-২৫ জন কর্মকর্তা। এইদিন সকালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই কর্মকর্তারা গভর্নরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ডেপুটি গভর্নর নূরুন নাহার ও ড. হাবিবুর রহমানের পদত্যাগের দাবি জানান। এরপর তারা দুপুর আড়াইটায় প্রধান কার্যালয়ের ৩০ তলা ভবনের সামনে সর্বদলীয় ঐক্যের ডাক দেন। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের পরেও এই আন্দোলনে গুটিকয়েক কর্মকর্তা ছাড়া কাউকে সাড়া দিতে দেখা যায়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ৩০ তলা ভবনের সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচি শেষ করে দাবিদাওয়া নিয়ে আবারও গভর্নর আহসান এইচ মনসুরের কার্যালয়ে যান তারা। এসময় গভর্নর কার্যালয়ে আন্দোলনকারী কর্মকর্তাদের মধ্যে তিন জন প্রতিনিধি প্রবেশের অনুমতি পান। অতিরিক্ত পরিচালক নজরুল ইসলামের নেতৃত্বে প্রতিনিধিরা গভর্নরের সাঙ্গে সাক্ষাৎ করে ডেপুটি গভর্নরদের পদত্যাগ দাবি করেন। তবে তাদের এই দাবি তাৎক্ষণিক না মেনে নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে প্যানেল ভিত্তিক নির্বাচন বন্ধ করা ও কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেন গভর্নর আহসান এইচ মনসুর।
সাক্ষাৎ শেষে গভর্নরকে উদ্ধৃত করে অতিরিক্ত পরিচালক নজরুল ইসলাম গণমাধ্যমকে বলেন, বর্তমানে ব্যাংক খাতে চলমান সংস্কার কার্যক্রমে আলোচ্য দুই ডেপুটি গভর্নরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকায় এখুনি তাদেরকে পদ থেকে সরানো যাচ্ছে না। তবে সময় হলে এ বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হবে। পাশাপাশি গভর্নর বলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকে যে রং-ভিত্তিক রাজনীতি রয়েছে এখান থেকে বের হতে হবে। নির্বাচন নিয়ে দলীয়ভাবে কাজ না করে ব্যক্তিবিশেষ নির্বাচন করবেন। তাহলে নির্বাচন কেন্দ্র করে বিশৃংখলার সুযোগ থাকবে না। এছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বিভিন্ন সংগঠনের চলমান নির্বাচনগুলো একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত স্থগিত থাকার কথা জানিয়েছেন গভর্নর।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বিভিন্ন সংগঠনের নির্বাচনে তিনটি প্যানেল প্রতিনিধিত্ব করছে। নীল ও হলুদ দলের পাশাপাশি নবগঠিত সবুজ দলের প্যানেল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। এই অরাজনৈতিক প্যানেলগুলোর প্রতিটিতেই সব রাজনৈতিক মতাদর্শের কর্মকর্তারা রয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক কর্মকর্তা। মূলত, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে রং-ভিত্তিক দলীয় রাজনীতি বিদ্যমান থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংকের এই নির্বাচন নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়েছে বলে মনে করছেন তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই অস্থিরতার সূত্র অনুসন্ধানে দেখা গেছে, গত ২০ নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের অফিসার্স ওয়েলফেয়ার কাউন্সিলের নির্বাচনকে কেন্দ্র করেই দুই ডেপুটি গভর্নরের পদত্যাগের আন্দোলন শুরু হয়েছে। এই নির্বাচনে নীল দলের প্যানেল থেকে সভাপতি ও সাধারণ সম্পদক সহ ৯ জন প্রার্থী বিজয়ী হন। হলুদ দল থেকে ৫ জন সহ নবগঠিত সবুজ দল থেকে একজন প্রার্থী বিজয়ী হয়েছেন। মূলত, নির্বাচনে কিছু প্রার্থী হেরে যাওয়ায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অস্থিরতা সৃষ্টির অভিযোগ উঠেছে। তারা অভিযোগ তুলেছেন, জ্যেষ্ঠ দুই ডেপুটি গভর্নর তাদেরকে সহযোগিতা না করে প্রতিপক্ষকে সহযোগিতা করায় তারা নির্বাচনে হেরে গেছেন। তবে এই অভিযোগের সত্যতা মেলেনি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই নির্বাচনকে কেন্দ্র করে কিছু কর্মকর্তার ক্ষোভকে নিজেদের স্বার্থ উদ্ধারে ব্যবহার করার চেষ্টা করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছু কর্মকর্তা।
জানা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের বর্তমান চার ডেপুটি গভর্নর নূরুন নাহার, ড. হাবিবুর রহমান, জাকির হোসেন চৌধুরী ও ড. মো. কবির আহমেদ জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে নিয়োগ পেয়েছেন। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের হস্তক্ষেপে দুই ডেপুটি গভর্নরসহ ৪ শীর্ষ কর্মকর্তা পদত্যাগ করেন। খালি হওয়া দুইটি পদে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে ডেপুটি গভর্নর নিয়োগ পান জাকির হোসেন চৌধুরী ও ড. কবির আহমেদ।
এদিকে আন্দোলনকারী কর্মকর্তারা গভর্নরের সঙ্গে সাক্ষাত করে যাওয়ার পর অফিসার্স ওয়েলফেয়ার কাউন্সিলের নবনির্বাচিত কমিটি গভর্নরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এসময় নীল দলের পাশাপাশি সবুজ দল ও হলুদ দলের বিজয়ী প্রার্থীরাও উপস্থিত ছিলেন।
সবুজ দলের প্যানেলে নির্বাচন করেছেন এমন একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ঐতিহ্যগতভাবেই বাংলাদেশ ব্যাংকে কোনো রাজনৈতিক প্যানেল নাই। এখানে মূলত অরাজনৈতিক তিনটি প্যানেল রয়েছে। সব মতাদর্শের লোকেরাই প্রতিটি প্যানেলে রয়েছেন। আমাদের কাছে মনে হচ্ছে, মানুষের আবেগকে কাজে লাগিয়ে কেউ হয়তো নিজেদের ফায়দা হাসিলের চেষ্টা করছেন। কেউ যাতে এই সুযোগ না পান সেজন্য আমরা সতর্ক আছি। যে কারণে আপনারা দেখতে পেয়েছেন, সর্বদলীয় ঐক্যের ডাক দেওয়া হলেও সেখানে কর্মকর্তাদের উপস্থিতি ছিল না। অর্থাৎ, বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা কারো ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারের হাতিয়ার হতে চান না।