খুলনা: সুন্দরবনের ভেতরে প্রবাহিত খালে বিষ প্রয়োগ করে মাছ শিকারের প্রবণতা দিন দিন বাড়ছেই। বেপরোয়া হয়ে উঠেছে অসাদু জেলেদের একটি চক্র।
এই বিষ প্রয়োগে মাছ আহরণ অব্যাহত থাকলে এক সময় সমগ্র সুন্দরবন এলাকায় মৎস্যশূন্য হয়ে যাবে এবং সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যসহ উদ্ভিদ সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন পরিবেশবিদরা।
অনুসন্ধান করে জানা যায়, জেলেরা সুন্দরবনের খালে জোয়ারের আগে চিঁড়া, ভাত বা অন্য কিছুর সঙ্গে কীটনাশক মিশিয়ে খালের পানিতে ছিটিয়ে দেয়। এর কিছুক্ষণের মধ্যেই বিভিন্ন প্রজাতির মাছ পানিতে ভেসে ওঠে। জেলেরা ওই মাছ ধরে স্থানীয় আড়তসহ বিভিন্ন হাটবাজারে সরবরাহ করেন।
অভিযোগ রয়েছে, এক শ্রেণির অসাদু বনরক্ষীদের নিয়মিত মাসোহারা দিয়ে জেলেরা বিষ প্রয়োগ করে মাছ শিকার করছেন। এজন্য ট্রলার প্রতি ১০ হাজার এবং নৌকা প্রতি ৫ হাজার টাকা গুনতে হয় তাদের। বন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে তারা অভয়ারণ্যের খালে বিষ দিয়ে অল্প সময়ে অধিক মাছ শিকার করে থাকেন। এছাড়া জেলেদের শিকার করা মাছ নিরাপদে লোকালয়ে পৌঁছাতেও টাকা দিতে হয় স্থানীয় আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের। মাঝেমধ্যে ২/১ জন ধরা পড়লেও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় অপরাধচক্রটি দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
জানা যায়, সুন্দরবনে পর্যটকসহ মাছ ও কাঁকড়া আহরণে প্রবেশ নিষেধাজ্ঞার মধ্যে প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় অব্যাহতভাবে চলছে বিষ দিয়ে মাছ শিকারের কার্যক্রম। বনবিভাগ ও স্থানীয় প্রশাসন অভিযান চালিয়েও দমন করতে পারছেন না তাদের।
সুন্দরবন উপকূলবর্তী কয়রা উপজেলার ইয়াসিন, কামাল, আল আমিনসহ বেশ কয়েকজনের পাশাপাশি বন বিভাগের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, স্থানীয় কয়েকজন জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক ব্যক্তি, কয়েকজন মৎস্য আড়তদার, দাদনদাতা এমনকি সংবাদকর্মীদের ছত্রছায়ায় অসাদু জেলেরা সুন্দরবনে প্রবেশ করে। তাদের সঙ্গে আছে এক শ্রেণির কীটনাশকবিক্রেতা। চক্রের লোকজন ওই বিক্রেতাদের কাছ থেকে অবাধে কীটনাশক সংগ্রহ করে তা মাছ ধরার কাজে অপব্যবহার করছে। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে বনবিভাগের কিছু অসাদু বনরক্ষী ও কর্মকর্তা উৎকোচের বিনিময়ে এসব দেখেও না দেখার ভান করেন। ফসলের পোকা দমনে ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের কীটনাশক দিয়ে এসব মাছ শিকার করা হয়। এর মধ্যে ডায়মগ্রো, ফাইটার, রিপকর্ড এবং পেসিকল নামক কীটনাশকই বেশি ব্যবহার করেন জেলেরা।
স্থানীয়রা জানান, সুন্দরবনের কয়রা অংশের তেঁতুলতলার চর, ৬ নং কয়রা, ৪ নং কয়রা, জোড়সিং, নীলকোমল, মোংলার ঢাংমারী, মরাপশুর, জোংড়া, ঝাপসি, ভদ্রা, নীল কমল, হরিণটানা, কোকিলমুনী, হারবাড়িয়াসহ শরণখোলা, বটিয়াঘাটা, শ্যামনগর, আশাশুনির বেশ কয়েকজন মৎস্যদস্যু বিষ দিয়ে মাছ ধরছে।
সুন্দরবন পশ্চিম বন বিভাগ সূত্রে জানা যায়, ১ জুন থেকে ৩১ আগস্ট পর্যন্ত তিন মাসের জন্য সুন্দরবনে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। এ সময় বনের নদী-খালে মাছ ও কাঁকড়া ধরার পাশাপাশি পর্যটক প্রবেশেও নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সরকার। এই বন্ধ মৌসুমে সুন্দরবনে খুলনা ও সাতক্ষীরা রেঞ্জে অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে গেল দুই মাসে ১১৬টি মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ সময় ১২৪ জেলেকে আটক করা হয়েছে।
জানা যায়, নিষিদ্ধ সময়ে সুন্দরবনের খুলনা রেঞ্জ অবৈধ প্রবেশের দায়ে ২৭ টি পিওআর মামলা, ৩৪টি ইউডিওআর মামলা ও ০১টি সিওআর মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ সময় ২৩ জন আসামিকে আটক করা হয়। এছাড়া একটি ইঞ্জিন চালিত ট্রলার, ৬৩টি নৌকা, ৪টি মোটরসাইকেল, ১৬ কেজি হরিণের মাংস, ৬৩৯ কেজি চিংড়ি / সাদা মাছ, ৩৫ কেজি শুঁটকি চিংড়ি ১৯০ কেজি, কাঁকড়া, ৬০০টি হরিণ ধরা ফাঁদ ও ১৪টি বিষের বোতল জব্দ করা হয়।
সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জ থেকে গত ২ মাসে ৮টি ইঞ্জিনচালিত ট্রলার, ১৩০টি নৌকা এবং অবৈধ কাঁকড়া পরিবহনকালে একটি পিকআপ ভ্যান জব্দ করা হয়েছে। এ সময় ১০১ জনকে আটক করা হয়েছে। ৭টি পিওআর মামলা, ৩১ টি ইউডিওআর মামলা এবং ১৬ টি সিওআর মামলা দায়ের করা হয়েছে।
এসবের পাশাপাশি উদ্ধার করা হয়েছে অবৈধ ভেসালি জাল, নিষিদ্ধ কীটনাশক, হরিণের মাংস ও ধরার ফাঁদ, শুটকি চিংড়িসহ অন্যান্য সরঞ্জাম। বিভাগীয় পর্যায়ে মামলা নিষ্পত্তির মাধ্যমে ২৩ লাখ ৩৬ হাজার টাকা রাজস্ব আদায় করা হয়েছে।
পশ্চিম সুন্দরবনের কাশিয়াবাদ স্টেশন কর্মকর্তা শ্যামা প্রসাদ রায় বলেন, সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার মহাজন নামধারি কতিপয় ব্যক্তি প্রতি বছর নিষিদ্ধ সময়ে বনের খালে মাছ শিকারের চেষ্টা করেন। এলাকার জেলেদের দাদনের ফাঁদে ফেলে বিষ দিয়ে মাছ শিকারে উৎসাহিত করেন তারা। আবার কেউ কেউ জেলেদের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে সংরক্ষিত বনের খালে বিষ দিয়ে মাছ শিকার ও পাচারে সুযোগ করে দেন। তারা বনরক্ষীদের টহলের গতিবিধি লক্ষ্য করে জেলেদের সতর্ক করে থাকেন। বিষ দিয়ে মাছ শিকার নির্মূলে আমাদের অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
কয়রা থানার অফিসার ইনচার্জ মো. মিজানুর রহমান বলেন, বিষ দিয়ে মাছ ধরা নিয়ন্ত্রণে বনবিভাগের পাশাপাশি আমরাও নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছি। গত চার দিনে বিষ দিয়ে ধরা ৩৮০ কেজি চিংড়ি জব্দ করা হয়েছে। এর সঙ্গে জড়িত চারজনকে আটক করেছি।
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান অনুষদের শিক্ষক অধ্যাপক আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, বিষ প্রয়োগ করলে ছোট-বড় সব প্রজাতির মাছ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মাছের পোনা মারা যায়। এছাড়া বিষমিশ্রিত পানি ভাটার টানে যখন গভীর সমুদ্রের দিকে যায়, তখন সেই এলাকার জলজ প্রাণীও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া আশপাশের মাটিতে মিশে বিষের প্রভাব দীর্ঘ সময় থাকে। ফলে জলজ প্রাণীদের প্রজনন ক্ষমতা কমে যাওয়ার পাশাপাশি স্বাস্থ্য ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দিন দিন জলজ প্রাণীর সংখ্যা কমে যাচ্ছে। পাখি ও বড় যে প্রাণী আছে যারা এসব মাছ খেয়ে বেঁচে থাকে তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে মাছ, পাখি এবং মাছের উপর নির্ভরশীল অন্যান্য প্রাণীদের জীবন চক্রের পরিবর্তন আসছে।
সুন্দরবনে বিষ দিয়ে মাছ শিকার প্রসঙ্গে বৃহস্পতিবার (১০ আগস্ট) সকালে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপমন্ত্রী বেগম হাবিবুন নাহার বাংলানিউজকে বলেন, সুন্দরবনের সব খালের মাথায় একজন করে লোক দাঁড় করে রাখার মতো জনবল তো আমাদের নেই। জনগণ নিজেরাই সুন্দরবনের সম্পদ নষ্ট করলে আমরা কি করে রক্ষা করব। কয়রাসহ সুন্দরবন এলাকায় অনেক খাল রয়েছে। একটা খালকে পাহাড়া দেওয়া যায়। শত শত খাল কে পাহাড়া দেবে? মানুষ যদি নিজেরা ঠিক না হয়। রাজহাঁস সোনার ডিম পারবে ওরা সেই রাজহাঁসটাকেই মেরে খেয়ে নিতে চায়। তাহলে খাক তারা। আমি কি করব? এত বুঝালেও বোঝে না। শুধু কয়রায় নয় সারা সুন্দরবনে সব জায়গায় বিষ দিয়ে মাছ শিকারের সমস্যা রয়েছে।