বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের আইনি ব্যবস্থা থেকে দায়মুক্তি দিতে ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’ প্রণয়ন করা হয়।
১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ এ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেন।
খন্দকার মোশতাকের কুখ্যাত ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে ১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই আইনে পরিণত করে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের নেতৃত্বাধীন দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ।
রোববার (৯ জুলাই) কুখ্যাত এ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশকে আইনে পরিণত করার ৪৪তম বার্ষিকী।
ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ কী এবং কেন জারি করা হয়
ইনডেমনিটি শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘শাস্তি এড়াইবার ব্যবস্থা’। আর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বা আইন তৈরির কারণ হচ্ছে কোনো অপরাধের বিচার করা যাবে না, এটা আইনের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হয়।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে তৈরি ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ হলো সেই অধ্যাদেশ যার মাধ্যমে হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের শাস্তি এড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বিশ্বের ইতিহাসে আইনের মাধ্যমে এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের বিচারের পথ রুদ্ধ করার ইতিহাস দ্বিতীয়টি নেই।
তৎকালীন রাষ্ট্রপতি (পরবর্তীতে আদালতের আদেশে অবৈধ) খন্দকার মোশতাক আহমেদ ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যার পেছনে যারা জড়িত ছিল, তাদের শাস্তির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য এ অধ্যাদেশটি জারি করা হয়।
সংসদের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে রাষ্ট্রপতি হওয়া খন্দকার মোশতাক আহমেদ সংসদ ভেঙে দেন। এরপর বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বাঁচাতে তাদের দায়মুক্তি দিতে ১৯৭৫ সালে ২৬ সেপ্টেম্বর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেন। এটি ১৯৭৫ সালের অধ্যাদেশ নম্বর ৫০ নামে অভিহিত ছিল।
এরপরে সামরিক স্বৈরশাসক জিয়ার বিরোধী দমন-পীড়নের মুখে ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে সামরিক স্বৈরশাসক জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ২০৭টি আসনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে।
১৯৭৯ সালের ৯ জুলাই বাংলাদেশ সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর পর বিএনপি নেতৃত্বাধীন দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ এটাকে আইনে রূপান্তর করে। এর ফলে রুদ্ধ হয়ে যায় বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের যাবতীয় প্রক্রিয়া।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের দীর্ঘ ২১ বছর পরে ক্ষমতায় এসে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর সপ্তম জাতীয় সংসদে এ ইনডেমনিটি আইন বাতিল করা হয়। এর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু হত্যাকারীদের বিচারের পথ প্রশস্ত হয়। আর ২০১০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সংবিধানের ৫ম সংশোধনীকেই অবৈধ ঘোষণা করেন হাইকোর্ট।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচার
১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর ধানমন্ডি থানায় মামলা দায়েরের মাধ্যমে শুরু হয় বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারকার্য। এরপর ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর মামলার যাবতীয় কার্যক্রম শেষে ১৫ জন আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেন নিম্ন আদালত। এরপর আসামি পক্ষের ১৫ জন উচ্চ আদালতে আপিল করলে ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল এবং তিনজনকে খালাস দেওয়া হয়।
২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত চারদলীয় জোট সরকার ক্ষমতায় এলে এ মামলার কার্যক্রম আবারও স্থবির হয়ে যায়। এরপর ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে আবারও এ বিচারকার্য শুরু হয়। ২০০৯ সালে লিভ-টু-আপিলের মাধ্যমে এ বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। আপিল শেষে ১২ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন সুপ্রিম কোর্ট।
হত্যাকারীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর
২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জড়িত পাঁচজন কর্নেল ফারুক, মেজর বজলুল হুদা, মেজর শাহরিয়ার রশিদ, মেজর এ কে এম মহিউদ্দিন ও ল্যান্সার মহিউদ্দিনের ফাঁসির মাধ্যমে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
দীর্ঘদিন পলাতক থাকার পরে অন্য আসামি ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদ গ্রেপ্তার হলে ২০২০ সালের ১২ এপ্রিলে তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
মৃত্যুদণ্ডের রায় হওয়া বাকি পাঁচজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল ডালিম, মেজর রাশেদ, মেজর নুর, আব্দুর রশীদ ও মোসলেম উদ্দিন এখনও পলাতক রয়েছে।
পলাতকদের মধ্যে একজন লেফটেন্যান্ট কর্নেল আজিজ পাশা এরমধ্যে বিদেশের মাটিতে মৃত্যুবরণ করে।