ঢাকা: ‘আমদানি করে লাভ কি? দাম কমার থেকে বাড়ছে বেশি!’ গত কয়েকদিন ধরে কাঁচামরিচ নিয়ে মানুষের মুখে মুখে ঘুরে ফিরছে এই কথা। ঝাল এ পণ্যের অস্থিতিশীলতা কমাতেও পারছে না সরকার। তাই কার্যত ‘বোমা’ হয়ে বাজার থেকে ভোক্তার ঘরে ঘরে যাচ্ছে মরিচ।
ঈদের পর ভারত থেকে আমদানির প্রভাবে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছিল কাঁচা মরিচের বাজারে। কিন্তু কয়েকদিন না পেরুতেই ফের অস্থিরতা তৈরি হয়েছে এ পণ্যের বাজারে। আমদানির পর প্রথম দুদিন কাঁচা মরিচ ২৮০ থেকে ৩০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও গত দুদিন ধরে বিক্রি হচ্ছে ৪০০-৫০০ টাকায়। কেন, কী কারণে এ প্রশ্নের উত্তর বাজার সংশ্লিষ্টদের কাছে নেই। নেই ভোক্তাদের কাছেও। প্রান্তিক বিক্রেতারা বাধ্য, তাই খোঁজও নেন না।
শনিবার (৮ জুলাই) রাজধানীর খিলগাঁও রেলগেট বাজার, মেরাদিয়া হাট, বাসাবো বাজারসহ বিভিন্ন এলাকার বেশকিছু সবজির দোকান ঘুরে কাঁচামরিচের দাম বৃদ্ধির তথ্য, ক্রেতা-বিক্রেতাদের আক্ষেপ সম্পর্কে জানা গেছে।
সাধারণ ক্রেতারা কাঁচা মরিচের অস্বাভাবিক দাম বৃদ্ধি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। বিক্রেতারা বলছেন তারা সামনের দিন আর্থিক ক্ষতির দিকে যাচ্ছেন।
ক্রেতারা বলছেন, দাম বাড়ার কারণে সরকার যেখানে কাঁচা মরিচ আমদানির অনুমতি দিয়েছে। সেখানে দাম কমেনি। কারণ, সিন্ডিকেটের প্রভাব। প্রতিটি বাজারে, আড়তে এই সিন্ডিকেট ‘সিস্টেম’ করে। তাদের সিস্টেমের কারণে ভোক্তারা তাদের ন্যায্য ক্রয় বঞ্চিত হচ্ছে। বাজারে কাঁচা মরিচের দাম বাড়ছে, আরও বাড়বে। ভারত থেকে মরিচ আনার পরও সিন্ডিকেটকারীদের দৌরাত্ম কমেনি। তারা দাম বাড়িয়েই যাচ্ছে।
ক্রেতারা জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর খামখেয়ালি করছেন বলেও অভিযোগ করছেন। তাদের দাবি, বাজার তদারকিতে ভোক্তা অধিদপ্তর নিয়মিত অভিযান চালায়। এতে খামখেয়ালি আছে। তা না হলে দাম বাড়তির দিকেই যায় কীভাবে। সংস্থার কোনো প্রভাব দেখা যাচ্ছে না বাজারে।
সচেতন মহলেরও প্রশ্ন, ভারত থেকে কাঁচা মরিচ আমদানি করে কী লাভ হলো যদি দাম না-ই কমে?
কাঁচা মরিচের দাম নিয়ে ক্রেতা-বিক্রেতাদের মধ্যে বেশ ঝামেলা হচ্ছে। বাজারে তো হয়-ই; পাড়া-মহল্লার দোকানেও ঝগড়া-বিবাদ দেখা যায়। দরকষাকষির সঙ্গে কথা কাটাকাটিও করেন তারা। অনেক ক্রেতাকে মরিচ না কিনেও ফিরতে দেখা যায়। কেউ আবার চাহিদার তুলনায় কম মরিচ কিনে ফিরে যাচ্ছেন।
মেরাদিয়া হাটের এক সবজির দোকান থেকে ৪২ টাকা দিয়ে ১০০ গ্রাম কাঁচা মরিচ কেনেন ইসরাত জাহান নীলা। এত কম পরিমাণ মরিচ দিয়ে কী হবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কিছু করার নেই। কিনতে তো হবেই। আগে দুইদিন পর পর আড়াইশো গ্রাম কাঁচা মরিচ বাসায় প্রয়োজন হতো। আমাদের বাসায় ঝাল বেশি খাওয়া হয়। কিন্তু কাঁচা মরিচের দাম বাড়ায় চাহিদা বেশি থাকলেও কম কিনতে হচ্ছে।
বাসাবো বৌ বাজার এলাকায় ভ্রাম্যমাণ সবজি বিক্রেতা মো. আলমগীর মিয়া জানান, আজ তিনি দেশি কাঁচা মরিচ বিক্রি করছেন পোয়া প্রতি (২৫০ গ্রাম) ৮০ টাকায়। কেজি ৩২০। ভারতীয় মরিচ বিক্রি করছেন এক পোয়া (২৫০ গ্রাম) ১০৫ টাকায়, আর কেজি ৪২০ টাকায়। বাজারে ভারতীয় কাঁচা মরিচের দাম বেশি বলেও তিনি জানালেন।
আলমগীর বলেন, আমি বাজার থেইকা প্রতিপাল্লা (৫ কেজি) আমদানি করা ভারতীয় কাঁচামরিচ কিনি দুই হাজার ট্যাকায়। দেশি কাঁচামরিচ প্রতি পাল্লা ১৪০০ ট্যাকা। সেই হিসাবে পাইকারি বাজারে ভারতীর কাঁচামরিচের দাম পড়ে ৪০০ এবং দেশি কাঁচা মরিচের দাম পড়ে ২৮০ টাকা।
বাজারের বিক্রেতারা বলছেন, দাম বাড়ার পর থেকে তারা আগের চেয়ে কম পরিমাণে মরিচ কিনছেন। এটি পচনশীল, যে কারণে বেশি মরিচ তুলছেন না। কারণ, বিক্রি না হলে মরিচ পচে যাবে। এতে বড় আর্থিক ক্ষতির মুখ দেখবেন তারা।
তা ছাড়া, সামনের দিনগুলোয় যদি মরিচের দাম কমতে থাকে, এতেও তারা আর্থিক ক্ষতির শিকার হবে। কারণ, বেশি দাম দিয়ে মরিচ কিনে কমে তারা বিক্রি করতে পারবেন না। বৃষ্টির কারণ মরিচ নিয়ে বাজারে যা হচ্ছে, সেটি নিয়ে তারাও চিন্তিত।
কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাবের) ভাইস প্রেসিডেন্ট এস এম নাজেরও কাঁচা মরিচের দাম নিয়ে সন্তুষ্ট নন। তিনি বলেন, ভারতীয় কাঁচামরিচের দাম যদি বাড়ে তাহলে আমদানি করে তো আমাদের কোনো লাভ নেই। লাভ হচ্ছে সরকারের; কিছু ডিউটি বা ট্যাক্স পাচ্ছে। তবে আমাদের মতে কাঁচা মরিচের দাম নিয়ে যে কারসাজি এটা ব্যবসায়ীদের সৃষ্টি করা।
সেদিন একটি টকশোয় দেখলাম, হিলি বন্দরের এক আমদানিকারক বলছেন ভারত থেকে আমদানি করা কেজি প্রতি ২০ টাকা মূল্যের কাঁচা মরিচে ভ্যাট দিতে হয় ৩২ টাকা। অন্য দিকে পেঁয়াজের বেলায় প্রতি কেজিতে ভ্যাট ৬ টাকা। তো কাঁচামরিচের জন্য কি আলাদা কোনো নীতি আছে? মোট কথা ব্যবসায়ীরা মানুষকে বোকা বানিয়ে বেশি মুনাফা করছে এবং মুনাফা বাড়ানোর জন্যই বিভিন্ন অজুহাতকে তারা সামনে আনছে।
দাম নিয়ন্ত্রণে করনীয় কী জানতে চাইলে ক্যাবের ভাইসপ্রেসিডেন্ট বলেন, যেহেতু ব্যবসায়ীরা বলছে তাদের বেশি ডিউটি দিয়ে আনতে হচ্ছে পাশাপাশি তাদের খরচটা বেশি পড়ছে। সেটা সরকার থেকে যাচাই করে একটা বক্তব্য দেওয়া উচিত যে প্রতিটা পণ্যে এনবিআর কত রাজস্ব আদায় করছে। পাশাপাশি কৃষি মন্ত্রণালয়ের বলা দরকার এসব পণ্য নষ্ট না হয়ে কত দিন পর্যন্ত স্বাভাবিক থাকে। একই সঙ্গে পুরো সাপ্লাই চেনে কোথায় সমস্যা আছে এটা যদি খুঁজে বের করা না হয় তাহলে জিনিসের দাম কমানো সম্ভব হবে না।
তিনি বলেন, এসব বিষয় যদি সরকারের পক্ষ থেকে পরিষ্কার না করা হয় তাহলে ব্যবসায়ীরা সবসময় আমাদের বোকা বানিয়ে অতি মুনাফা করবে। যদি দাম বেড়ে যায় তাহলে আমদানি করে আমাদের লাভ কি? সেখানে তো উল্টা আমাদের কৃষকরা আরও ক্ষতিগ্রস্ত হবে।