লোকসভা ভোটের ফলাফল স্পষ্ট হতেই মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে নরেন্দ্র মোদির ইস্তফা দাবি করলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। মমতার কথায়, ‘মোদিজি অনেক রাজনৈতিক দল ভেঙেছেন। এই ভোটে দেশের মানুষ তার মাজা ভেঙে দিয়েছে। এবার নৈতিক পরাজয় স্বীকার করে ইস্তফা দিন উনি।’
মমতা ব্যানার্জি আরও বলেন, ভোটের আগে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, মোদির গ্যারান্টির কথা। মানুষ তা প্রত্যাখ্যান করেছে। দেশের মানুষের বিশ্বাসযোগ্যতা হারিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। এবার পশ্চিমবঙ্গে ৪২টি আসনের মধ্যে মমতার তৃণমূল কংগ্রেস একাই পেয়েছে ৩০টি আসন। বিজেপি পেয়েছে মাত্র ১১টি, কংগ্রেস একটি আসন জিতেছে মালদহে। হেরে গিয়েছেন লোকসভায় কংগ্রেসের দলনেতা অধীররঞ্জন চৌধুরী।
হেরে গিয়েছেন বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ, প্রাক্তন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী নিশীথ প্রামাণিক, অভিনেত্রী লকেট চট্টোপাধ্যায়। পশ্চিমবঙ্গ থেকে জিতে সংসদে যাচ্ছেন তৃণমূলের তরফে দুই বাংলার জনপ্রিয় অভিনেত্রী শতাব্দী রায়, রচনা বন্দ্যোপাধ্যায়, বিশ্বকাপজয়ী ক্রিকেটার কীর্তি আজাদ, ইউসুফ পাঠান। প্রায় সাড়ে ছয় লাখের রেকর্ড মার্জিনে জিতেছেন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মমতার ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়।
মমতা ব্যানার্জি এদিন সন্ধ্যায় যখন সাংবাদিকদের সঙ্গে বৈঠক করেন, তখনও ভারতের বেশকিছু আসনে ভোটগণনা প্রক্রিয়া চলছে। তবে মোটামুটিভাবে স্পষ্ট যে চব্বিশের এ সাধারণ নির্বাচনে ভারতে বিজেপির একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার লক্ষণ আর নেই। তার ওপর বাংলায় স্যুইপ করেছে তৃণমূল। সন্দেহ নেই এতে যারপরনাই উচ্ছ¡সিত তৃণমূল কংগ্রেস তথা মমতা ব্যানার্জি।
বস্তুত এই কারণেই রীতিমতো হুংকার দিয়ে মমতা বলেন, ‘এ হলো অহঙ্কারীর দর্পচ‚র্ণ। এত অহঙ্কার ভালো নয়। নরেন্দ্র মোদি আগে পাঁচ লাখ ভোটের ব্যবধানে জিততেন। সেই ব্যবধান দেড় লাখে নেমে এসেছে। ইন্ডিয়া জিতেছে, মোদি হেরেছে।’ সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, পশ্চিমবঙ্গে শাসকদলের বিরুদ্ধে বিবিধ দুর্নীতির অভিযোগ থাকলেও ভোটের ফলে তার প্রভাব পড়েনি। ভোট শতাংশ বাড়িয়েছে জোড়াফুল শিবির। যা দলের গণভিত্তি কতটা মজবুত, তা বোঝার অন্যতম সূচক। দিলিবাড়ির লড়াইয়ের ফল বঙ্গ রাজনীতিতে অভিষেকের সেনাপতিত্বকে ‘প্রতিষ্ঠা’ দিল। প্রশ্নের মুখে পড়ে গেল বিরোধী দলনেতা শুভেন্দুর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ।
এবার লোকসভা ভোটের আগে দুই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে গ্রেফতার করেছে কেন্দ্রীয় তদন্ত এজেন্সি। ঝাড়খন্ডের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী হেমন্ত সরেন ও দিলির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল এখন জেলে রয়েছেন। মমতা ব্যানার্জি বলেন, ‘নির্লজ্জ ভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করা হয়েছে। ইডি, সিবিআইকে দিয়ে আমাদের ওপর অত্যাচার করা হয়েছে। এমনকি বিরোধী দলের নেতাদের ফোনে হুমকি দেওয়া হয়েছে। টাকার প্রলোভন দেওয়া হয়েছে। এই অনাচার দেশের সহ্য হয়নি।’ মমতার কথায়, ওরা ভেবেছিল ফের লাফিয়ে লাফিয়ে সরকারে আসবে। তারপর নিজের ইচ্ছেমতো আইন পাশ করাবে। তা আর হবে না। এবার তা করতে গেলে বিরোধীরা চেপে ধরবে। ইডি, সিবিআইয়ের অত্যাচার আর চলবে না। ইচ্ছামতো আইন পাশ করা যাবে না।
মমতা জানান, এদিন ফলাফল স্পষ্ট হতেই উত্তরপ্রদেশের সমাজবাদী পার্টি নেতা অখিলেশ যাদব তাকে ফোন করেছিলেন। তিনি নিজেও রাহুল গান্ধীকে শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়েছেন। মমতা বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন, বিজেপি জোট সরকার গড়ে ক্ষমতায় এলেও আগামী দিন তাদের খুব মসৃণ হবে না। সংসদের ভেতরে-বাইরে চেপে ধরবেন বিরোধীরা।
‘বাংলা ম্যাজিক দেখাবে’ সাক্ষাৎকারে দাবি করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সত্যিই ম্যাজিক দেখাল বাংলা। তবে নেতিবাচক ম্যাজিক। এক্সিট পোলকে ডাহা ভুল প্রমাণ করে রাজ্যে সবুজ ঝড় তুলল তৃণমূল। আর বিজেপির ঝুলিতে মাত্র ১১ আসন। রাজনীতির দাবা খেলায় কোন ভুল চালে ছিটকে গেল বঙ্গ বিজেপি? মোদি-শাহ-নাড্ডারা বাংলার ডেলি প্যাসেঞ্জারি করেছেন। প্রচারে ঝড় তুলেছেন। রোড শো করেছেন খোদ নরেন্দ্র মোদি। কিন্তু তাতে লাভ বিশেষ হলো না। গো-হারা হারল বঙ্গ বিজেপি। রাজনৈতিক মহল বলছে, একটা নয়, একাধিক কারণ রয়েছে বিজেপির বিপর্যয়ের।
পশ্চিমবঙ্গে বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে বুথফেরত সমীক্ষা যখন দেখিয়েছিল, বাংলায় তৃণমূলের ‘ভরাডুবি’ হতে চলেছে, তখন দলের প্রার্থী, জেলা সভাপতিদের নিয়ে বৈঠক করে তিনিই বলেছিলেন, ‘চোয়াল শক্ত’ রাখতে। তৃণমূল কমবেশি ৩০টা আসন জিতবে। নিজের ভবিষ্যদ্বাণী মিলিয়ে দেওয়ার পাশাপাশিই তিনি সম্মুখসমরে পাঁচ গোল মেরেছেন শুভেন্দু অধিকারীকে। ‘সেনাপতি’ থেকে হয়ে উঠেছেন ‘ক্যাপ্টেন’। মঙ্গলবার দিলিবাড়ির লড়াইয়ে যে ফলাফল হলো বাংলায়, তাতে ২০২১ সালের বিধানসভা ভোটের পরে আরও একবার দলের অভ্যন্তরে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেল সেনাপতি অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্ব। প্রতিষ্ঠিত হল সামগ্রিক ভাবে বাংলার রাজনীতিতেও।
দেখা গেল কৌশল, সংগঠন, প্রচার, অভিমুখ নির্ধারিত করা সব ক্ষেত্রেই বিজেপিকে কয়েক যোজন পেছনে ফেলে দিলেন অভিষেক। সে অর্থে তিনিই এই ভোটের আসল ‘হিরো’। ভোটের প্রচার পর্বে অভিষেকের বক্তৃতায় নির্দিষ্ট ‘অভিমুখ’ ছিল। যে অভিমুখ কখনও ঘুরে যায়নি। দেখা গিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বা অমিত শাহেরা বাংলায় এসে তৃণমূলের বিরুদ্ধে যা যা বলেছিলেন, তার পালটা বলছেন মমতা ব্যানার্জি।
অভিষেক সেভাবে মোদি-শাহদের জবাব দেওয়ার পথে হাঁটেননি। তিনি শুধু তুলনামূলক রাজনৈতিক পরিসংখ্যান তুলে ধরে আক্রমণ শানিয়েছিলেন বিজেপিকে। তার বক্তব্যের মূল উপজীব্য ছিল মমতার সরকার কী কী দিচ্ছে বাংলার জনগণকে। বাংলার মানুষের কী কী ‘প্রাপ্য’ আটকে রেখেছে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার। যে প্রাপ্য আদায়ের দাবি নিয়ে গত বছর সেপ্টেম্বরে দিলিতে আন্দোলন নিয়ে গিয়েছিলেন অভিষেক। তারপর রাজধানীতে ধরনা, অবস্থান-বিক্ষোভ, পুলিশি ধরপাকড় এবং শেষে কলকাতায় ফিরে রাজভবনের সামনে ধরনায় বসে পড়া অন্য অভিষেককে দেখেছিল বাংলা।
ভোটের ফল নিয়ে দুজনের দাবি প্রায় এক ছিল।
শুভেন্দু বলেছিলেন, সংখ্যা তিনি বলবেন না। তবে তৃণমূলের থেকে একটি হলেও বেশি আসন পাবে বিজেপি। অর্থাৎ, তৃণমূল যদি ২০টি পায়, তা হলে বিজেপি অন্তত ২১টি আসন পাবে। অন্যদিকে, ষষ্ঠ দফার ভোটের পরে অভিষেক বলেছিলেন, ‘আগের বার ২২টা পেয়েছিলাম। পৃথিবী রসাতলে গেলও ২৩টা এবার পাবই।’ দেখা গেল অভিষেক তার অনুমান বাস্তবায়িত করতে পেরেছেন। অভিষেক নিজেও বিপুল ভোটে ডায়মন্ড হারবার কেন্দ্রে জিততে চলেছেন। অভিষেকের নেতৃত্ব তথা তার জয়ের ব্যবধান নিয়ে বিজেপির রাজ্য সভাপতি তথা বালুরঘাটে কঠিন লড়াইয়ের মুখোমুখি সুকান্ত মজুমদার বলেছেন, ‘ওর জয় বা ওদের দল নিয়ে আমি কিছু বলব না। ফল নিয়ে আমরা আমাদের দলে আলোচনা করব।’
২০২১ সালের বিধানসভা ভোট থেকেই মমতার ভাইপো অভিষেক সংগঠনে ‘বিশেষ’ ভূমিকা নেওয়া শুরু করেছিলেন। যদিও তখন তার পাশে ছিলেন ভোটকুশলী প্রশান্ত কিশোর। কিন্তু এবার তিনি নেই। তবে পেশাদার সংস্থা আইপ্যাক এ ভোটে কাজ করেছে। প্রার্থীচয়নে এ সংস্থার সমীক্ষাও বিশেষ ভ‚মিকা নিয়েছে। দেখা যাচ্ছে আরামবাগ, ঝাড়গ্রামের মতো আসনে চমকপ্রদ প্রার্থী দেওয়া তৃণমূলের জন্য কার্যকর হয়েছে। অন্যদিকে, দিলীপ ঘোষকে বর্ধমান-দুর্গাপুরের মতো আসনে লড়তে পাঠানো বা অগ্নিমিত্রা পালকে মেদিনীপুরে পাঠানোর শুভেন্দু-কৌশল কাজে আসেনি।