রামনাথ বিশ্বাস একজন বিপ্লবী,অনুশীলন সমিতির সদস্য,বৃটিশ নৌবাহিনীর সৈনিক,প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক, প্রথম বাঙ্গালী ভুপর্যটক।সাইকেলে চড়ে ৫৩ হাজার মাইল, পায়ে হেঁটেছেন ৭ হাজার মাইল, জাহাজে এবং রেলগাড়ীতে ২৭ হাজার মাইল অতিক্রম করেছেন।
১০ বছরে প্রায় ৮৭ হাজার মাইল পথ বিশ্বভ্রমনে রামনাথ বিশ্বাস পাড়ি দিয়েছেন। ১৮৯৪ সালের ১৩ জানুয়ারী হবিগঞ্জ জেলার বানিয়াচং থানার বিদ্যাভূষণপাড়ায় রামনাথ বিশ্বাস জন্মগ্রহণ করেন। পিতার নাম বিরজানাথ বিশ্বাস ও মাতার নাম গুণময়ী দেবী। রামনাথ বিশ্বাস বানিয়াচঙ্গ হরিশ্চন্দ্র উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেন। রামনাথ বিশ্বাস হবিগঞ্জ শহরে জাতীয় ভান্ডার সমিতির ম্যানেজার পদ যোগ দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন।
জাতীয় ভান্ডার সমিতির মোটর কারখানা থাকার সুবাদে মোটর ড্রাইভিং শিখেন এবং পারদর্শী হয়ে উঠেন। সাইকেল চালনায় বিশেষ পারদর্শী হয়ে ওঠেন। জাতীয় ভান্ডার সমিতির কাজ ছেড়ে অন্য একটি চাকরিতে যোগ দেন। এই সময়েই গোপনে অনুশীলন সমিতিতে যোগদান করেন। বিপ্লবী কর্মকান্ড প্রকাশ হয়ে গেলে চাকরি থেকে বহিষ্কৃত হন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে যুদ্ধে যোগ দেন। বাঙালী পল্টনের সঙ্গে মিশরে যান। ১৯২৪ সালে মালয়ে বৃটিশ নৌবাহিনীর একটি চাকরিতে যোগ দেন। ১৯৩১ সালে রামনাথ বিশ্বাস সাইকেলে প্রথম বিশ্বযাত্রা করেন। সঙ্গে এক জোড়া চটি, দু’টি চাদর ও সাইকেল। সাইকেলের কেরিয়ারে একটি বাক্সে সাইকেল মেরামতির সরঞ্জাম। সাইকেলের গায়ে লেখা ‘রাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড, হিন্দু ট্রাভেলার। ১৯৩১ সালের ৭ জুলাই রামনাথ বিশ্বাস সিঙ্গাপুরের কুইন স্ট্রীট থেকে এই বিশ্বযাত্রা শুরু করেন।
সিঙ্গাপুরে চাকরিরত প্রবাসী ভারতবর্ষের লোকেরা রামনাথ বিশ্বাসকে সেদিন শুভেচ্ছা জানাতে এসেছিলেন। সাইকেলে চড়ে রামনাথ মালয়,থাইল্যান্ড, ইন্দোচীন, চীন, কোরিয়া, জাপান হয়ে কানাডায় পৌঁছান। ১৯৩৪ সালে রামনাথ বিশ্বাস বানিয়াচং গ্রামে ফিরে আসলে গ্রামবাসীরা বানিয়াচঙ্গের ঐতিহাসিক এড়ালিয়া মাঠে এক বিশাল সংবর্ধনা সভার আয়োজন করেন। উক্ত সভায় রামনাথ বিশ্বাস তাঁর বিশ্বভ্রমণের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বানিয়াচঙ্গকে বিশ্বের বৃহত্তম গ্রাম বলে উল্লেখ করেন।
১৯৩৪ সালে রামনাথ বিশ্বাস দ্বিতীয়বার বিশ্বযাত্রা করেন। সেসময় আফগানিস্তান, পারস্য, ইরাক, সিরিয়া, লেবানন, তুরস্ক, বুলগেরিয়া, যুগোস্লাভিয়া, হাঙ্গেরী, অস্ট্রিয়া, চেকোস্লোভাকিয়া, জার্মানি, হল্যান্ড, বেলজিয়াম, ফ্রান্স হয়ে বৃটেন পৌঁছান। ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডও সাইকেলে পরিভ্রমণ করেন। এই যাত্রায় তার শরীর ভেঙে গিয়েছিল। ১৯৩৬ সালে রামনাথ বিশ্বাস লন্ডন থেকে জাহাজে পোর্ট সৈয়দ হয়ে বোম্বাই প্রত্যাবর্তন করেন। সুস্থ হয়ে কলকাতা শান্তিনিকেতনে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে যান। বিশ্বকবির সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলেন। ১৯৩৮ সালে রামনাথ বিশ্বাস তৃতীয়বার বিশ্বযাত্রা করেন।
সেসময় আফ্রিকা মহাদেশে পাড়ি দেন। বোম্বাই থেকে জাহাজে মোম্বাসায় পৌঁছে সেখান থেকে সাইকেল যাত্রা শুরু করেন। কেনিয়া, উগান্ডা, নায়াসাল্যান্ড, রোডেসিয়া হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকায় পৌঁছান। এখান থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভালো লাগেনি। ১৯৪০ সালে রামনাথ দেশে ফিরে আসেন। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগ হলে বৃহত্তর সিলেট জেলা পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়।
রামনাথ বিশ্বাস বানিয়াচঙ্গেই থেকে যান। কিন্তু ভ্রমণকাহিনী নিয়ে বই প্রকাশ করতে চাইলে কোন প্রকাশক এগিয়ে আসেনি। অগত্যা নিজেই পর্যটক প্রকাশনা ভবন নামে একটি প্রকাশনা সংস্থা খুলে নিজের বই প্রকাশ করতে শুরু করেন। রামনাথ বিশ্বাস পূর্ব পাকিস্তান ছেড়ে কলকাতায় চলে যান। ১৯৫৫ সালের ১ নভেম্বর প্রথম বাঙ্গালী ভুপর্যটক রামনাথ বিশ্বাস কলকাতায় মৃত্যুবরন করেন। কলকাতা শহরে তাঁর নামে রামনাথ লেন নামকরন করা হয়েছে।