ঢাকা: হত্যাকাণ্ডের দীর্ঘ সময় পর বিচার শেষে দুই দফায় বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ছয় খুনির ফাঁসি কার্যকর হলেও ৫ খুনি এখনও অধরা। এর মধ্যে দুজনের অবস্থান নিশ্চিত থাকলেও বাকী তিনজনের বিষয়ে কোনো তথ্য নেই।
আইনমন্ত্রী বলেছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দুই খুনি এএম রাশেদ চৌধুরী ও নূর চৌধুরীকে দেশে ফিরিয়ে আনার জোর চেষ্টা চলছে। দুই খুনির মধ্যে এএম রাশেদ চৌধুরী যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। এসএমবি নুর চৌধুরী আছেন কানাডায়। তাদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা আমরা চালিয়ে যাচ্ছি। নুর চৌধুরীকে ফিরেয়ে আনার ব্যাপারে কানাডা যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে, সেটা আমরা উত্তরণের চেষ্টা করছি। আমরা কানাডিয়ান সরকারকে অনুধাবন করানোর চেষ্টা করছি। একটা স্টেজে গিয়ে আমরা বলব, আমাদের যে এতদিনের বন্ধুত্ব, সেই বন্ধুত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাবে, যদি তাকে ফেরত না দেওয়া হয়। অন্যদিকে রাশেদ চৌধুরী সম্পর্কে এতটুকু বলতে পারি, আমরা আলোচনা করছি। আপাতত এর থেকে বেশি আর কিছু বলতে চাই না।
অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেছেন, এটা দুর্ভাগ্যজনক হচ্ছে আমাদের যারা মানবাধিকারের কথা বলে, আইনের শাসনের কথা বলে তাদের দেশে এই পলাতকগুলো আছে। এটা প্রতিটি রাষ্ট্রের নৈতিক দায়িত্ব পলাতক আসামি অর্থাৎ যার বিরুদ্ধে আদালতের দণ্ড আছে…তাদের ফেরত দিয়ে দণ্ড কার্যকরের ব্যবস্থা হবে বলে আশা করছি।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ তার পরিবারের সদস্যদের নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনার বিচার সচরাচর হত্যাকাণ্ডের মতো অতটা সহজ ছিল না। কারণ ১৯৭৫ সালে হত্যাকাণ্ড পরবর্তী সরকারগুলো বঙ্গবন্ধু পরিবারের আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিচার না করে বিভিন্ন সময় পুনর্বাসন করেছে। বঙ্গবন্ধু খুনের পরে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এলে হত্যাকাণ্ডে জড়িত সেনা কর্মকর্তাদের বিদেশে অবস্থানরত বাংলাদেশের বিভিন্ন কূটনৈতিক মিশনে চাকরি দেওয়া হয়।
দীর্ঘ পথ পেরিয়ে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর খুনিদের বিচারের উদ্যোগ নেয়। দীর্ঘপথ পরিক্রমা শেষে ২০১০ সালে বিচার প্রক্রিয়া শেষ হয় এবং ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি দিবাগত রাতে খুনি সৈয়দ ফারুক রহমান, বজলুল হুদা, এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ, সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান ও মহিউদ্দিন আহমেদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এ রায় কার্যকরের আগে ২০০১ সালে একজন আসামি আজিজ পাশা জিম্বাবুয়েতে মারা যান।
পলাতকরা হলেন- এম রাশেদ চৌধুরী, নূর চৌধুরী, খন্দকার আবদুর রশিদ, শরিফুল হক ডালিম, আব্দুল মাজেদ ও মোসলেহউদ্দিন খান। ২০২০ সালের ৭ এপ্রিল ভোরে পলাতক মাজেদকে ঢাকার গাবতলি থেকে গ্রেপ্তারের কথা জানায় সরকার।
এর আগে মাজেদ এতদিন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পালিয়েছিলেন। করোনাভাইরাস মহামারির সময় দেশে ফিরলে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে তিনি রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার চেয়ে আবেদন করেছিলেন। তা নাকচ হওয়ার পর ২০২০ সালের ২০ এপ্রিল কেরানীগঞ্জের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। রশিদ, ডালিম ও মোসলেহউদ্দিন সম্পর্কে সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিক কোনো এখন পর্যন্ত তথ্য নেই।
দায়মুক্তি আইন বাতিলের পর ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর ধানমন্ডি থানায় বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিগত সহকারী আ ফ ম মহিতুল ইসলাম বাদী হয়ে মামলা করেন। ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর তৎকালীন ঢাকার দায়রা জজ কাজী গোলাম রসুল মামলার রায়ে ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন। নিম্ন আদালতের এ রায়ের বিরুদ্ধে আসামিদের আপিল ও মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিতকরণের শুনানি শেষে ২০০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর হাইকোর্ট বিভক্ত রায় দেন। রায়ে জ্যেষ্ঠ বিচারপতি এম রুহুল আমিন ১৫ আসামির ১০ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। খালাস দেন পাঁচ আসামিকে। অপর বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক ১৫ আসামির সবার মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। নিয়ম অনুযায়ী ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল হাইকোর্টের তৃতীয় বেঞ্চের বিচারপতি মোহাম্মদ ফজলুল করিম ১২ আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। খালাস দেন তিনজনকে।
আসামিদের আবেদনের পর ২০০৭ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগের বিচারপতি মো. তাফাজ্জাল ইসলামের নেতৃত্ব তিন বিচারপতির বেঞ্চ পাঁচ আসামির আপিল শুনানির জন্য গ্রহণ করেন।
এর প্রায় দুই বছর পর ২০০৯ সালের ২৪ আগস্ট আপিল শুনানির জন্য রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি ওই বছরের ৫ অক্টোবর শুনানির দিন ধার্য করেন। আপিল শুনানির জন্য তৎকালীন প্রধান বিচারপতি এম এম রুহুল আমিন ওই বছরের ৪ অক্টোবর বিচারপতি মো. তাফাজ্জাল ইসলামের নেতৃত্বে পাঁচ বিচারপতির বিশেষ বেঞ্চ গঠন করেন। শুনানি শেষে ১৯ নভেম্বর চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করেন।
এরপর আসামিদের করা পুনর্বিবেচনার আবেদনও ২৭ নভেম্বর খারিজ করে দেন আপিল বিভাগ। পরে ৫ খুনির ফাঁসি কার্যকর করা হয়।