উত্তরের প্রকৃতিতে বইছে শীতের আগমনী বার্তা। সকালের শিশির ভেজা ঘাস আর হালকা কুয়াশায় প্রস্তুত হচ্ছে প্রকৃতি। সেই সঙ্গে আগাম খেজুরের রস সংগ্রহে প্রস্তুত হতে দেখা যাচ্ছে এই অঞ্চলের গাছিদেরও। শীত এলেই গ্রামীণ জীবনের প্রাত্যহিক উৎসব শুরু হয় এই খেজুর গাছকে কেন্দ্র করেই।
অগ্রহায়ণ থেকে মাঘ এই তিন মাস খেজুর রস সংগ্রহ করা হয়। সপ্তাহের দুই থেকে তিন দিন রস সংগ্রহ বন্ধ রাখা হয়। এর ফলে গাছের রস ভালো হয়। গাছের মালিকদের তিন মাসে দশ কেজি করে গুড় দিতে হয়। রস থেকে তৈরি গুড় গাছিরা বাজারে বিক্রি করেন। গাছিরা তিন মাসে একটি গাছের রসের গুড় বিক্রি করে দেড় থেকে দুই হাজার টাকা আয় করেন।
এই সময়ে শীতের আগমনে খেজুর রস সংগ্রহের জন্য রামগঞ্জ উপজেলার প্রত্যস্ত এলাকায় খেজুর গাছ পরিস্কার করতে স্থানীয় গাছিরা এখন মহাব্যস্ত হয়ে পড়েছে। উপজেলার সর্বত্রই খেজুরের গাছ তৈরির কাজ প্রায় শেষ হলেও শুরু হয়েছে কিছু কিছু এলাকায় এখন রস সংগ্রহের পালা।
ফলে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যের প্রতীক ঘিরে গ্রামীণ জনপদে শুরু হয়েছে উৎসব মুখর পরিবেশ। খেজুর রস সংগ্রহ করে কিছুদিনের মধ্যে আমন ধান ঘরে তোলার পালা ফলে নতুন ধানের পিঠা, পুলি ও পায়েশ তৈরির ধুম পড়ে গেছে গ্রামে গ্রামে। তাছাড়া খেজুরের গুড় দিয়ে মুড়ির মোয়া, চিড়ার মোয়া ও মুড়ি খাওয়ার জন্য কৃষক পরিবার থেকে শুরু করে সর্বস্তরের মানুষের কাছে শীতের মৌসুমে এ রস দিয়ে হরেক রকম খাবার অতি প্রিয় হয়ে ওঠেছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, রামগঞ্জ উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের ছোট-বড় বিভিন্ন রকমের খেজুরের গাছ ঝুঁকি নিয়ে গাছিরা গাছের তোলা কাটা শেষ করেছে। কোমরে মোটা রশি বেঁধে গাছ ঝুলে ঝুলে রস সংগ্রহের জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছে গাছিরা। পেশাদার গাছিদের তেমন কোন সমস্যা না হলেও রস সংগ্রহের জন্য স্থানীয় এক শ্রেণীর উৎসুক মানুষও পিছিয়ে নেই। তারা দুঃসাহসিকতা শক্তি নিয়ে গাছে উঠা-নামা করেছে রস সংগ্রহের জন্য। আশ্বিনের শুরুতেই গাছের তোলা ও পরিচর্যা করে আসছেন গাছিরা। খেজুর গাছ সুমিষ্ট রস দেয়। রস থেকে তৈরি হয় গুড় ও পাটালি।
যার স্বাদ ও ঘ্রাণ মানুষকে মুগ্ধ করে। তাছাড়া খেজুরের রসের তৈরি পিঠা-পুলি আর পায়েস যেন শীতকে করে তোলে আরো পরিপূর্ণ। তাই এ অঞ্চলজুড়ে খেজুরের রসের চাহিদাও রয়েছে প্রচুর। উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের গাছি কামাল, রহিম, তোতাময়িা, মনির হোসেন, আতা মিয়া জানান, ঝুঁকি নিয়েই কোমরে রশি (দড়ি) বেঁধে গাছে ঝুলে রস সংগ্রহের কাজ করেন এই গাছিরা। প্রতিদিন বিকালে ছোট-বড় কলসি (মাটির পাত্র) গাছে বাঁধা হয়, আর সকালে রস সংগ্রহ করা হয়।
কেউ কেউ কাঁচা রস এলাকার বিভিন্ন স্থানে ও হাটে-বাজারে খাওয়ার জন্য বিক্রি করেন। আবার কেউ কেউ সকালেই এই রস জ্বালিয়ে গুড় তৈরি করেন। গাছ একবার ছাঁটলে ৩-৪ দিন রস সংগ্রহ করা হয় এবং পরবর্তীতে ৩ দিন শুকাতে হয়। এইভাবে কাটলে গাছের রস সুমিষ্ট হয়। রস সাধারণত ডিসেম্বর হতে এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত সংগ্রহ করতে হয়। রস সংগ্রহের পর হাড়ি পরিষ্কার করে রৌদ্রে শুকাতে হয় অথবা আগুনে ছেকে নিতে হয়।
এতে সংগৃহীত রসে গাঁজন বন্ধ হয়। তারা আরো জানান, যারা খেজুর রসের পাগল তারা শহর থেকে গ্রামে ছুটে আসেন। কাঁচা রস প্রতি ভাঁড় ২৫০ থেকে ৩০০ টাকায় বিক্রি হয়। রস জাল দেওয়ার পর গুড় তৈরি করে বিভিন্ন হাটবাজারে বিক্রি করা হয়। প্রতি কেজি খাটি গুড় ৪৫০ টাকা থেকে ৬০০ টাকা, প্রতি কেজি হাজারী গুড় এক হাজার থেকে ১ হাজার ২০০ টাকায় বিক্রি হয়ে থাকে।
রামগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিসার জানান, সারাদেশে পরিকল্পিতভাবে খেজুর গাছ রোপণ করা দরকার। তাহলে শীত মৌসুমে উপাদেয় রস দেশীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা রাখতে পারবে। খেজুরের ঐতিহ্য ধরে রাখতে দেশি চারার পাশাপাশি বিদেশি চারাও রোপণ করা প্রয়োজন।