রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে(বেরোবি)
বৈষম্য বিরোধী জুলাই বিপ্লবের বিরোধিতা করেও ক্যাম্পাসে দাপটে চলছেন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের আ. লীগ গ্রন্থী নীল দলের সাবেক সভাপতি এবং সাবেক প্রক্টর গোলাম রব্বানী। এমনকি নিজ বিভাগের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে যেতে বাধা দেওয়ার বিষয়ে গুঞ্জন উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে।
জানা যায়, ১৪ জুলাই এক সংবাদ সম্মেলনে
শেখ হাসিনা কোটা সংস্কার আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী শিক্ষার্থীদের রাজাকার বলায়
সেই রাতেই “তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার।
কে বলেছে কে বলেছে স্বৈরাচার স্বৈরাচার।”স্লোগানে কম্পিত হয় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস।
ছাত্রদের এই আন্দোলনের তীব্র বিরোধিতা করে প্রতিপক্ষ স্বৈরাচার সরকার পাল্টা স্লোগান দেয়।
“তুমি কে আমি কে বাঙালি বাঙালি।”
তারই পরিপ্রেক্ষিতে আবু সাঈদ হত্যার আগের দিন ১৫ জুলাই রাত ১টা ২১ মিনিটে মোঃ গোলাম রব্বানী
তার ফেসবুক ওয়ালে শেখ হাসিনার ছবি পোস্ট করে লিখেন “তুমি কে আমি কে বাঙালি বাঙালি”।
সেই পোষ্টের মন্তব্যের ঘরে শিক্ষার্থীরা লিখেন”
পা চাটা দালাল না হয়ে ন্যায্য কথা বলুন..। আসলে পা চাটা দালাল দিয়ে দেশটা ভরে গেছে …”
কমেন্টে তিনি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের রাজাকার বলেননি বলে দাবি করে পোস্টের প্রতিউত্তরে লিখেন, “আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কোথায় বলেছেন আন্দোলনকারীরা রাজাকার। আমি তো খুঁজে পেলাম না। তাদের’ রাজাকার ‘ শব্দের মাধ্যমে প্রতিবাদের ভাষার সাথে আমি একমত নই। আমি ঘৃনা ভরে তা প্রত্যাখান করছি।” এছাড়া তিনি শিক্ষার্থীদের অনেকটা হুমকি দিয়ে লিখেন, “প্রত্যেকে তার কর্মফল ভোগ করবে, অতীতেও করেছে, ভবিষ্যতেও করবে।”
তিনি আরেকটি কমেন্টে পাঁচ অক্ষরের একটি ইংরেজি শব্দ দিয়ে রাজনৈতিক ভাষায় লিখেন,”মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মন্ত্রীর ছবি দেখছেন না।”
তিনি আন্দোলনকারীদের উদ্দেশ্য করে আরও লিখেন, “দুদিন পরে এদেশের চেয়ারে বসতে তারা কি লজ্জাও পাবে না?”
তার পোস্টের নুর নবি মিয়া নামের একজনের কমেন্টের প্রতিত্তোরে তিনি লিখেন, Nur Nabi Miah দেখুন, কোমল মতি শিক্ষার্থীগণের দাবী আমার কাছে অযৌক্তিক মনে হলে আমি এই কোটা সংস্কার আন্দোলনকে সমর্থন করতাম না। আমি নিজে মনে করি কোটার যৌক্তিক সংস্কার হওয়া উচিত। কিন্তু কোন সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ কোনরকম অনুশোচনা ছাড়া ‘রাজাকার’ স্লোগান দিতে পারে না।’রাজাকার’রা ছিলো পাকিস্তানের পক্ষে আর স্বাধীন বাংলা দেশের বিপক্ষে। আজকে যে শিক্ষার্থীরা স্লোগান দিলো, সেই ‘রাজাকার ‘ শব্দটি স্বাধীন বাংলা দেশের ইতিহাসে একটা ঘৃন্য শব্দ ( মির জাফরের মতো ঘৃন্য শব্দ ) । প্রতিবাদের ভাষা এরকম জঘন্য হতে পারে না।
এরপর তারা যখন সেই দেশের চেয়ারগুলোতে বসবে তখন কি লজ্জাও লাগবে না। আমি তাদের শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের বিপক্ষে ছিলাম না। কিন্তু তাদের’ রাজাকার ‘ শব্দের মাধ্যমে প্রতিবাদের ভাষার সাথে আমি একমত নই। আমি ঘৃনা ভরে তা প্রত্যাখান করছি।প্রত্যেকে তার কর্মফল ভোগ করবে, অতীতেও করেছে, ভবিষ্যতেও করবে।
সেটা সকলের ক্ষেত্রে সমানভাবে প্রযোজ্য। সুতরাং তাদের শান্তিপূর্ণ যোক্তিক আন্দোলনকে সাপোর্ট করা মানে এই নয় তাদের সবকিছুর দ্বায় আমাকে নিতে হবে।আর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কোথায় বলেছেন আন্দোলনকারীরা রাজাকার। আমি তো খুঁজে পেলাম না, থাকলে দয়া করে আমাকে ভিডিও টা দেবেন কি? আমিও একটু দেখতে চাই।
আমি ইতিহাসের ছাত্র হিসেবে এটা জানি মুক্তিযোদ্ধাদের যেমন লিস্ট আছে রাজাকারদেরও লিস্ট আছে( যদিও সকল রাজাকারের লিস্ট সংরক্ষিত আছে বলে আমার জানা নেই)।সেই রাজাকারদের সন্তান বা নাতি- নাতনিরা তো সত্যি কোটা পাবেনা। কারণ ‘রাজাকার’ নামে তো কোটা নেই এবং এটা সম্ভবও নয়। ধরুন, কারোও দাদা বা বাবা রাজাকার, তার জন্যও কিন্তু মেধার অংশ উন্মুক্ত রয়েছে। আন্দোলনকারীরা রাজাকার এটা তো শুনিনি।
একই প্রতিউত্তরে তিনি আরো বলেন,আমার চিন্তা ধারা আপনার সাথে না মিললেই কি আমি পা চাটা হয়ে গেলাম। আপনার উদ্দেশ্য আমাকে শাস্তি দেওয়া হলে এ প্রসঙ্গে আর আলোচনা করবনা।কারণ আপনি ইতোমধ্যে নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিয়েই রেখেছেন। যাহোক কোটা আন্দোলন নিয়ে আজকের পরে আর কথা বলতে চাইনা। আমি কথা বললেও ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা ও শিশু মুক্তিযোদ্ধারা যেমন বহাল তবিয়তেই থাকবে তেমনি এই নির্লজ্জ স্লোগান দেওয়ার পর কোটা আন্দোলন কে সমর্থন না করলেও তারা তাদের কাজের জন্য লজ্জিত হবে না। ধন্যবাদ ভালো থাকবেন।”
সরকার পতনের পর সেই ফেসবুক পোস্টটি ডিলিট করে দিলেও স্ক্রিনশটগুলো এখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রুপগোলোতে ঘুরপাক খাচ্ছে।
শিক্ষক রাব্বানী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় বিভিন্নভাবে তার বিভাগের শিক্ষার্থীদের আন্দোলন করতে বাঁধা দিয়েছেন।এ বিষয়ে ভুক্তভোগী এক শিক্ষার্থীর সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, “এই তথ্যগুলো নেওয়ার ক্ষেত্রে আপনারা আমাকে একটু এড়িয়ে গেলে ভালো হয়।কারণ আমার আর একটা সেমিস্টার আছে,আমার মাস্টার্স পাশ করতে হবে। ”
এ বিষয়ে আবু সাঈদের সহযোদ্ধা রোবায়েড হোসেন বলেন, আমি একজন আন্দোলনকারী হিসেবে মনে করি যেসব ফ্যাসিস্টদের দালাল আন্দোলনের সমর্থন করেনি বরং যারা সমর্থন করছে তাদের হয়রানি করার জন্য মামলা করার উদ্যোগ নিয়েছিল। শহীদ আবু সাঈদের এই ক্যাম্পাসে তাদের দাপটে চলাফেরা করা ক্যাম্পাসের জন্য লজ্জাজনক। এত বছর যিনি ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালযয়ে অরাজকতা সৃষ্টি করেছেন তিনি এখনো কার ইন্ধনে ক্যাম্পাসে দাপটে চলেন ,বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এর দ্রুত তদন্ত করে
সিদ্ধান্ত নেবেন বলে আমরা আশাবাদী।
এ বিষয়ে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বেরোবি শিক্ষার্থী তুহিন রানা বলেন,দ্বিতীয় গণঅভ্যুত্থানের পরেও আবু সাঈদের ক্যাম্পাস বেরোবি স্বৈরাচার মুক্ত হতে পারেনি। স্বৈরাচারের দোসর শিক্ষকদের আ. লীগ গ্রন্থী নীল দলের সাবেক সভাপতি এবং সাবেক প্রক্টর গোলাম রব্বানী এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়েই গেছে। গোলাম রব্বানী ছিলেন সাবেক উপাচার্য ড. হাসিবুর রশীদের প্রধান প্লানিং মাস্টার। তিনি প্রক্টরের পদ ফিরে পাবার আশায় বিভোর ছিলেন। ১১ জুলাই থেকে ১৬ জুলাই পর্যন্ত ছাত্র নির্যাতনের মূল পরিকল্পনাকারি ছিলেন এই সাবেক প্রক্টর। তিনি ছাত্রলীগকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তাছাড়া যুবলীগ নেতা ওর্যাড কমিশনার শিবলুর নেতৃত্বে অস্ত্রধারী ক্যাডারদের ক্যাম্পাসে ঢুকান। স্বৈরাচারী সরকারকে ক্ষমতায় রাখার জন্য ব্যাপক অর্থ ব্যয় করেন এই শিক্ষক।
তুহিন রানা আরও বলেন, ১৫ জুলাই সাবেক স্বৈরাচার সরকার যখন ছাত্র জনতাকে রাজাকার বলে গালি দেয় সেই দিনই এই শিক্ষক তার ফেসবুক পেজে ছাত্রলীগকে সমর্থন করে একটি পোস্ট করেন। শহীদ আবু সাঈদ হত্যা কান্ডের পর ১৭ তারিখ ও পরবর্তীতে যেসকল শিক্ষক উপাচার্য, প্রক্টরিয়াল বডি, ছাত্র উপদেষ্টা ও বহিরাঙ্গন পরিচালকের বিচারের দাবি করেছেন এই ধরনের ১০ জন শিক্ষকসহ ছাত্রদের বিরুদ্ধে মামলা করার প্রস্তুতি নেন। এই কুলাঙ্গার শিক্ষক ৪ আগস্ট গণহত্যার পক্ষে স্বৈরাচারী সরকারের পক্ষে ছাত্র জনতার আন্দোলনকে বিএনপি জামাতের আন্দোলন দেখিয়ে একটি ফেসবুক পোস্ট করেন। যা একজন শিক্ষকের কাছে আশা করা যায় না। স্বৈরাচার সরকারের পতনের পর ৬ আগস্ট এই গোলাম রব্বানী প্রক্টর হবার জন্য ব্যাপক লবিং করেন। তার ১৫ জুলাই ও ৪ আগস্টের পোস্ট স্পষ্ট গণহত্যাকে সমর্থন করে। শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে এতসব করার পরেও কার মদদে তিনি ক্যাম্পাসে এখনো দাপটে চলেন এটাই ভাবার বিষয়।
এ বিষয়ে আবু সাঈদের সহযোদ্ধা শামসুর রহমান সুমন বলেন,”শিক্ষকগণ দলীয়করণ হয়ে যাবার ফলে তাঁরা যতটা না শিক্ষার্থীদের কথা চিন্তা করেন তার থেকে বেশি চিন্তা করেন লেজুড়বৃত্তিক সেই দলের কথা।ফলতঃ নৈতিক স্খলন এবং ছাত্র শিক্ষক সম্পর্কের দৈন্য দশা। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় আইনে তা নিষিদ্ধ থাকলেও মানেন না অনেকেই।আশা করি নতুন প্রশাসন এ ব্যাপারে সজাগ দৃষ্টি রাখবেন।”
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দৈনিক আমাদের মাতৃভূমিকে নিশ্চিত করেন প্রক্টর ড. মো ফেরদৌস রহমান,তিনি বলেন, ছাত্র আন্দোলনে বিরোধিতা করলেও তো আমরা কোন অভিযোগ পাইনি তার বিরুদ্ধে। অভিযোগ আসলে আমরা অবশ্যই তদন্ত কমিটি গঠন করে তার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব ।